Sreemagal

শ্রীমঙ্গল

শ্রীমঙ্গল হলো বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা। এটি জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এবং পশ্চিমে হবিগঞ্জ জেলা ও দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে সীমান্ত ভাগ করে। শ্রীমঙ্গলকে বাংলাদেশের “চা রাজধানী” বলা হয়, কারণ এখানকার চা-বাগানগুলো দেশজুড়ে বিখ্যাত। চা ছাড়াও এ উপজেলায় রাবার, আনারস, কাঠ, সুপারি ও লেবুর চাষ এবং শিল্প গড়ে উঠেছে।

ইতিহাস

ধারণা করা হয়, শ্রীমঙ্গল নামটি এসেছে দুই ভাই শ্রী দাসমঙ্গল দাস-এর নাম থেকে, যাঁরা হাইল হাওরের তীরে বসতি গড়েছিলেন। কালাপুরে ১১শ শতকের রাজা মরুন্দনাথের একটি তাম্রলিপি আবিষ্কৃত হয়েছে। লামুয়ায় খননকালে প্রাচীন অনন্ত নারায়ণের মূর্তি উদ্ধার করা হয়। ১৪৫৪ সালে নির্মিত নির্মাই শিব বাড়ি এখনও ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।

শ্রীমঙ্গল থানা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১২ সালে এবং পরবর্তীতে ১৯৩৫ সালে এটি পৌরসভায় রূপান্তরিত হয়। ১৯৬৩ সালে পুলিশ দুই কৃষককে গুলি করলে বলিশিরা কৃষক বিদ্রোহ শুরু হয়।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ৩০ এপ্রিল শ্রীমঙ্গল পৌঁছে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং নারীদের উপর যৌন সহিংসতা চালায়। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ক্যাম্প ও ওয়াপদা অফিস এলাকা ছিল দু’টি গণহত্যাস্থল। বর্তমানে ভরাউরায় দুটি গণকবর রয়েছে এবং উত্তর ভরাউরায় শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে।

ভূগোল

শ্রীমঙ্গল ২৪.৩০৮৩° উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১.৭৩৩৩° পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। এ উপজেলার মোট আয়তন ৪৫০.৭৩ বর্গ কিলোমিটার এবং এখানে প্রায় ৬৫,১৬৫টি পরিবার বসবাস করে। শ্রীমঙ্গলের উত্তরে মৌলভীবাজার সদর, দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, পূর্বে কমলগঞ্জ উপজেলা এবং পশ্চিমে চুনারুঘাট, নবীগঞ্জবাহুবল উপজেলা অবস্থিত।

অর্থনীতি ও পর্যটন

মাধবপুর লেক শ্রীমঙ্গলের অন্যতম প্রধান পর্যটন আকর্ষণ। এটি বাংলাদেশের একমাত্র স্থান যেখানে সাদা-গলাযুক্ত হেরন (Great White-Bellied Heron) এর নিশ্চিত উপস্থিতি রয়েছে। কাছাকাছি আরেকটি জলাভূমি, বাইক্কা বিলে, বিরল প্রজাতির লার্জ-বিল্ড রিড ওয়ার্বলার পাখির আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত।

শ্রীমঙ্গলকে বাংলাদেশের “চা রাজধানী” বলা হয়, কারণ এখানে অসংখ্য সবুজ চা-বাগান রয়েছে। এখানেই উৎপত্তি হয়েছে জনপ্রিয় সাত রঙের চা, যা তার বৈচিত্র্যময় রঙ এবং স্বাদের জন্য বিখ্যাত। শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত বাংলাদেশ টি রিসার্চ ইনস্টিটিউট চা শিল্পে মান উন্নয়ন ও গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

চা ছাড়াও, শ্রীমঙ্গলের আনারস সারাদেশে তার প্রাকৃতিক মিষ্টতা ও স্বাদের জন্য পরিচিত।

২০১০ সালে রাজকান্দি বনাঞ্চলে আবিষ্কৃত হয় হাম হাম ঝরনা, যা বর্তমানে শ্রীমঙ্গলের আরেক জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে সারা বাংলাদেশের প্রকৃতি প্রেমীদের আকৃষ্ট করছে।

শ্রীমঙ্গলের চা-বাগান

শ্রীমঙ্গলকে বাংলাদেশের “চা-রাজধানী” বলা হয়, কারণ এখানে রয়েছে দেশের সর্বাধিক সংখ্যক চা-বাগান। সবুজে ঘেরা পাহাড়ি টিলা ও মৃদু ঢালু জমিতে ছড়িয়ে থাকা এই চা-বাগানগুলো শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয়, সৌন্দর্য ও পর্যটনের জন্যও অসাধারণভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শ্রীমঙ্গলে প্রায় শতাধিক ছোট-বড় চা-বাগান রয়েছে, যার মধ্যে লাউয়াছড়া, ভাড়াউড়া, শমশেরনগর ও রাজঘাট চা-বাগান উল্লেখযোগ্য।

চা-বাগান এলাকায় ঘুরতে গেলে দেখা যায় সারি সারি চা-গাছ, চা-শ্রমিকদের ব্যস্ততা এবং প্রাকৃতিক নিসর্গের অপার শোভা। এখানকার চা-পাতা মানের দিক থেকে অনেক উন্নত, যা দেশীয় বাজার ছাড়াও আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করা হয়। চা-বাগান ঘেরা এলাকায় গড়ে উঠেছে অনেক ট্যুরিস্ট স্পট, রিসোর্ট ও চা সংক্রান্ত জাদুঘরও।

শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (BTRI) দেশের চা শিল্পের মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই অঞ্চলে উৎপন্ন চা পাতার স্বাদ ও সুগন্ধের জন্য শ্রীমঙ্গলের চা দেশজুড়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *