


বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাগেরহাট জেলার সবচেয়ে পরিচিত ও ঐতিহাসিক স্থাপনা হলো ষাট গম্বুজ মসজিদ। এটি শুধুমাত্র বাংলাদেশেরই নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন মসজিদ। মুসলিম স্থাপত্য, ইতিহাস ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের অনন্য এক নিদর্শন হিসেবে এ মসজিদ পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়।
এই ব্লগে ধাপে ধাপে জানবো ষাট গম্বুজ মসজিদ সম্পর্কে বিস্তারিত।
১. ষাট গম্বুজ মসজিদ কোথায় অবস্থিত?
ষাট গম্বুজ মসজিদ অবস্থিত বাগেরহাট জেলার সদর উপজেলার খানজাহান আলী থানার অন্তর্গত শুভরাড়া গ্রামে। বাগেরহাট শহর থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং খুলনা শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে এই ঐতিহাসিক মসজিদটি অবস্থিত।
২. ষাট গম্বুজ মসজিদের ইতিহাস
নির্মাণকাল:
এই মসজিদটি ১৫শ শতকে খানজাহান আলী (রহ.) কর্তৃক নির্মিত। তিনি ছিলেন একজন সুফি সাধক ও প্রশাসক, যিনি এই অঞ্চলে ইসলামের প্রচার ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব:
- ১৪৪২ থেকে ১৪৫৯ সালের মধ্যে মসজিদটি নির্মিত হয় বলে ধারণা করা হয়।
- এটি শুধু মসজিদ ছিল না, বরং একটি মাদ্রাসা, দরবার এবং সামাজিক মিলনকেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হতো।
নামের পেছনের গল্প:
বাস্তবে মসজিদটিতে ৭৭টি গম্বুজ রয়েছে, কিন্তু নাম রাখা হয়েছে ষাট গম্বুজ মসজিদ, সম্ভবত “ষাট” সংখ্যাটি প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
৩. মসজিদের স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য
গম্বুজ:
- মোট ৭৭টি গম্বুজ রয়েছে
- এর মধ্যে মাঝখানে ৭টি চলাচলের জন্য বড় গম্বুজ
- বাকি গুলো ছোট ও সারিবদ্ধভাবে স্থাপন করা
স্তম্ভ:
- ৬০টি পাথরের স্তম্ভ রয়েছে যা পুরো ছাদকে ধরে রেখেছে
- প্রতিটি স্তম্ভে রয়েছে দারুণ কারুকাজ
দেয়াল ও জানালা:
- মসজিদের দেয়ালগুলো পুরু এবং শক্তিশালী
- জানালাগুলো থেকে আলো প্রবেশ করে অভ্যন্তরে শান্তিময় পরিবেশ তৈরি করে
মেহরাব ও মিম্বার:
- দক্ষিণ দেয়ালে মূল মেহরাব
- পাশে রয়েছে সুন্দরভাবে খোদাইকৃত মিম্বার যেখানে ইমাম দাঁড়িয়ে খুতবা দিতেন
৪. কেন ঘুরতে যাবেন ষাট গম্বুজ মসজিদে?
- ইতিহাস ও স্থাপত্য একসাথে দেখা যাবে
- বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের স্বীকৃতি পেয়েছে
- ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জ্ঞানের জন্য উপযোগী
- ছায়াঘেরা পরিবেশে সময় কাটানোর দারুণ সুযোগ
- ছবি তোলার জন্য উপযুক্ত স্থান
৫. ষাট গম্বুজ মসজিদ বিশ্ব ঐতিহ্য
১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো ষাট গম্বুজ মসজিদকে “World Heritage Site” হিসাবে ঘোষণা করে।
এটি বাংলাদেশের তিনটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের একটি।
৬. কিভাবে যাবেন ষাট গম্বুজ মসজিদ?
ঢাকা থেকে:
বাসে:
- গাবতলী/সায়েদাবাদ থেকে খুলনাগামী বাসে উঠুন
- খুলনা থেকে বাগেরহাট শহরে আসুন
- বাগেরহাট থেকে রিকশা/সিএনজি করে মসজিদ এলাকায়
ট্রেনে:
- ঢাকা → খুলনা (সুন্দরবন/চিত্রা এক্সপ্রেস)
- খুলনা → বাগেরহাট → ষাট গম্বুজ মসজিদ
সময়:
ঢাকা থেকে মোট সময় লাগে ৭–৯ ঘণ্টা।
৭. খোলা সময় ও প্রবেশ মূল্য
বিষয় | তথ্য |
---|---|
খোলা সময় | সকাল ৯টা – সন্ধ্যা ৬টা |
সপ্তাহিক ছুটি | কোনো নির্দিষ্ট ছুটি নেই |
প্রবেশ মূল্য | বাংলাদেশি: ২০ টাকা |
বিদেশি: ২০০ টাকা | |
শিক্ষার্থীদের জন্য ছাড় রয়েছে |
৮. কী কী দেখবেন আশপাশে?
১. খানজাহান আলীর মাজার:
ষাট গম্বুজের পাশে এই সুফি সাধকের মাজারটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। এখানে একটি দিঘি ও কুমির রয়েছে।
২. ঘোড়দিঘি:
মাজারের পাশে অবস্থিত বিশাল দিঘি, যার কুমির এখনো দর্শনার্থীদের জন্য একটি বিশেষ আকর্ষণ।
৩. বাগেরহাট জাদুঘর:
মসজিদের পাশেই অবস্থিত এই জাদুঘরে স্থানীয় ইতিহাস ও স্থাপত্যের নিদর্শন প্রদর্শিত হয়।
৯. কোথায় থাকবেন?
কাছাকাছি হোটেল:
- Hotel Momtaz Tower, Bagerhat
- Hotel Abakash, Bagerhat
- Hotel Castle Salam, Khulna (উন্নত মানের)
আপনি চাইলে খুলনায় থাকলেও মসজিদ ঘুরে আসতে পারবেন।
১০. খাবার ব্যবস্থা
- বাগেরহাট শহরে লোকাল খাবারের দোকান রয়েছে
- মুসলিম হোটেল ও মেস রেস্টুরেন্ট জনপ্রিয়
- মসজিদের আশপাশে হালকা স্ন্যাকস পাওয়া যায়
১১. ভ্রমণ খরচ (প্রতি ব্যক্তি)
খরচের ধরন | আনুমানিক মূল্য |
---|---|
ঢাকা → খুলনা বাস | ৬০০–১০০০ টাকা |
খুলনা → বাগেরহাট | ৫০–১০০ টাকা |
প্রবেশ ফি | ২০ টাকা |
খাবার ও নাস্তা | ২০০–৩০০ টাকা |
নৌকা/রিকশা/যাতায়াত | ১০০–১৫০ টাকা |
মোট খরচ (দিনভ্রমণ) | ১০০০–১৫০০ টাকা |
১২. সফর করার পরামর্শ
- সকাল সকাল রওনা দিলে ভিড় কম পাবেন
- ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চাইলে গাইড নিতে পারেন
- ক্যামেরা সাথে নিন, তবে কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মেনে ছবি তুলুন
- ছাতা বা সানগ্লাস রাখুন, কারণ বেশিরভাগ সময় খোলা জায়গা
১৩. ছোটদের জন্য শিক্ষামূলক ভ্রমণ
ষাট গম্বুজ মসজিদ স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি আদর্শ শিক্ষামূলক ভ্রমণ স্থান। ইতিহাস, ধর্ম, স্থাপত্য ও সংস্কৃতির সমন্বয় এই স্থানে রয়েছে।
১৪. উপসংহার
ষাট গম্বুজ মসজিদ শুধু ইট–পাথরের স্থাপনা নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতি, ধর্মীয় ঐতিহ্য ও ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী। যারা ইতিহাস ভালোবাসেন, যারা স্থাপত্য দেখতে পছন্দ করেন, তাদের জন্য এটি অবশ্যই একবার ঘুরে দেখার মতো স্থান।
একটি দিন সময় বের করে আপনি ঘুরে আসতে পারেন এই বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ থেকে, যেখানে অতীত আজও বেঁচে আছে নিঃশব্দে।